শফিউদ্দিন : চুয়াডাঙ্গা সংস্কৃতি অঙ্গনে কালের সাক্ষী
- মোঃ আলাউদ্দীন
সাল ও মাসটা মনে আছে। তারিখটা স্মৃতি থেকে মুছে গেছে। ১৯৭৭ সালের ফেব্র“য়ারি মাসের শেষের দিকে। মরহুম আতিউর রহমান কোর্টের ভিতর বড় বুড়োর হোটেলে বসে তাঁর স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে গল্পে মাতিয়ে রেখেছেন শ্রোতাদের। টেবিলের উপর সদ্য প্রকাশিত ঊষা সাহিত্য বাসরের কিছু পত্রিকা। আতিউর ভাইয়ের ঐ একটি গুণ ছিল। তিনি যেখানে বসতেন, তিনিই হতেন একমাত্র বক্তা। আর সবাই শ্রোতা। তাঁর বক্তব্য মন্ত্রমুগ্ধের মত সকলে শুনতো। অথচ তাঁর সকল কথাই ছিল মানুষ, সমাজ, রাজনীতি ও রাষ্ট্রকে নিয়ে। আমার বড় ভাই ন্যাপ করতেন- সেই সুবাদে আতিউর ভাইকে আমি ভাই বলেই সম্বোধন করতাম। হোটেলে ঢুকতেই আমাকে কাছে ডাকলেন। একটা পত্রিকা আমার হাতে দিয়ে বললেন, আগামী সংখ্যায় তোর একটা লেখা চাই। ছোট গল্প হলে ভাল হয়। এ যেন আদেশ। আমি তো অবাক। লেখালেখির তেমন চর্চা নেই। আমতা আমতা করতে লাগলাম। বললেন, শোন্ আমি কোন কথা শুনতে চাইনে, তোকে লিখতেই হবে। আর হ্যাঁ, অফিস ছুটির পর আমার বাসায় চলে আসবি। তোকে এক জায়গায় নিয়ে যাব। সঙ্গে পাঁচটা টাকা আনবি। আতিউর ভাইয়ের যা বলার ভঙ্গি- এ আদেশ্য অমান্য করে কার সাধ্য। বাসায় গেলাম। আতিউর ভাই তৈরী হয়েই ছিলেন। তিন পকেটওয়ালা জামাটা গায়ে চাপাতে চাপাতে ঘর থেকে বের হয়ে এলেন। বললেন, চল্। দু’ জনে হাঁটছি। রূপছায়া সিনেমা হল ছাড়িয়ে হাসপাতালের দিকে মোড় নিলেন। কিছুদুর গিয়ে বায়ে একটি ছোট টালির ঘর। দরজা খোলাই ছিল। সরাসরি আমরা ভিতরে ঢুকে গেলাম। ভিতরে একটা সাধারণ চৌকি, কয়েকটা চেয়ার। একটা চেয়ারের সম্ভবত একটা হাতা ভাঙ্গা। চৌকির উপরে বসে আছেন দোহারা শরীরের উজ্জ্বল শ্যামলা এক ভদ্রলোক। চেয়ারে আরো দু’ জন বসা। আজ আর মনে করতে পারছিনা কে কে বসে ছিলেন। ঢুকেই আতিউর ভাই চৌকিতে উঠে গেলেন। চৌকিতে বসা ভদ্রলোককে সম্বোধন করে বললেন, শফি ভাই একে চেনেন? এ হলো আমার বন্ধুর ভাই- আলাউদ্দীন। আপনাকে দিয়ে গেলাম। আর হুকুম দিয়েছি ঊষা’র আগামী সংখ্যায় লেখা দিতে। আর ইনি হলেন শফিউদ্দিন। ঊষা সাহিত্য বাসরের সম্পাদক। আমরা পরস্পর হাত মেলালাম। শফি ভাইয়ের ঠোঁটে ছিল মৃদু হাসি। চোখ আমার চোখের উপর। সেদিন থেকেই আতিউর ভাইয়ের সুবাদে বয়সের বেশ ব্যবধান থাকা সত্ত্বেও শফিউদ্দিন আমার শফি ভাই হয়ে গেলেন। তারপরের ইতিহাস অনেকের জানা। সেই আতিউর ভাইকে মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই হারালাম। একই সালের ৭ জুলাই আতিউর ভাই মাত্র ৩৮ বৎসর বয়সে আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। সেদিন শফি ভাই এর কান্না আমরা আর থামাতে পারি না। পরের মাসেই চুয়াডাঙ্গা সম্মিলিত সাহিত্য গোষ্ঠী আতিউর ভাই স্মরণে ‘একটি নক্ষত্র’ নামে পত্রিকা বের করল। ঐ সংখ্যায় শফি ভাউ লিখলেন ‘মৃত্যুঞ্জয়ী বীর’ নামে একটি কবিতা। কবিতার ক’টি লাইন তুলে ধরছি-
বিরহে তোমার ঊষার বাসর, চেয়ে দেখ সাথী হীন/বেদনার ভারে দিশেহারা আজি বয়ে যায় তার দিন।
শেষ দু’টি লাইন ছিল :
ধূলি মলিন এই ধরণীতে তব সুরভী তোমারই ঝরে/রহিবে বাঁচিয়া, চিরদিন ধরি দুঃখী জনতার ঘরে।
পরের মাসেই ঊষার দ্বিতীয় সংখ্যা বের হলো। আমি লিখে ফেললাম একটি ছোট গল্প ‘সন্ধ্যায় ছুটি’। গল্পটির পাণ্ডুলিপি খুব ভয়ে ভয়ে শফি ভাইয়ের বাড়ী নিয়ে গেলাম। শফি ভাই বললেন, পড়েন। আমার কণ্ঠনালী শুকাতে শুরু করল। পড়ার সময় হাত কাঁপছে, শরীর ঘামছে। কিছুতেই সে কম্পন রোধ করতে পারছি না। চোখ তুলে তাকাতেও পারছিনা শফি ভাইয়ের দিকে। পড়া শেষ হলে মাথা নিচু করে বসে আছি। শফি ভাই চৌকি থেকে নেমে আসলেন। চেয়ার থেকে আমাকে তুলে আমার হাত দু’টো ধরে যে আবেগভরা কথাটি বললেন তা আজো আমার হৃদয়ে গেঁথে আছে। কারণ সেই বাণীটিই ছিল আমার সাহিত্য জীবনের প্রথম প্রেরণার বাণী। ‘আতিউর ভাইকে ধন্যবাদ, আপনাকে দিয়ে গেছেন। লেখা যেন থেমে না যায়, আমার অনুরোধ থাকলো’। আমার মনে হলো নতজানু হয়ে পায়ের ধূলো নিই। পারলাম না। লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে গেলাম। আজ নিজেকে বড় অপরাধী মনে হয়। কারণ পারিনি শফি ভাইয়ের সেদিনের সেই অনুরোধের সুরে আদেশের মর্যাদা রক্ষা করতে। লেখালেখির গতি ধরে রাখতে পারিনি নানান কারণে। ঊষার দ্বিতীয় সংখ্যার প্রিন্টিং কাজ শুরু হলো এম. হুসাইন আর্ট প্রেসে। সন্ধ্যায় শফি ভাইয়ের সাথে বসে পত্রিকা নিয়ে আলোচনা শেষে উঠে আসার সময় তিনি একবার প্রেস হয়ে যেতে বললেন। প্রেসে গেলাম। দেখলাম পত্রিকা বাইন্ডিং এর কাজ চলছে। বেশ কিছু বাইন্ডিং হয়ে গেছে। একটা পত্রিকা হাতে নিয়ে আমার ‘সন্ধ্যায় ছুটি’ খুঁজতে লাগলাম। ছাপার হরফে আমার লেখা দেখে কি যে আনন্দ অনুভূতি সেদিনকার তা আজো মনে হলে রোমাঞ্চিত হয়ে উঠি। সে রাতেই বাড়ীতে স্ত্রীকে, বড় ভাই সহ পরিবারের সকলকে একত্র করে গল্পটা পড়ে শুনালাম। শুরু হলো শফি ভাইয়ের সাথে পথচলা।
ইতিমধ্যেই চুয়াডাঙ্গায় মুক্তবাণী, বিসর্গ, অনুশীলন সহ বেশ ক’টি সাহিত্য সংগঠন গড়ে উঠেছে। একদিন আমরা বেশ ক’জন একত্রিত হয়ে আলোচনা করলাম সাহিত্য সংগঠনগুলোকে এক প্লাটফরমে আনলে কেমন হয়। এর জন্য আজ স্মরণ করতে হয় মওলা বক্স, আঃ রহিম, কবি সুন্দর রেজাউল হক, এম ইব্রাহিম, হামিদুল হক মুন্সী, ইকবাল আতাহার তাজ সহ অনেককে। সবার উপর শফি ভাই তো আছেনই। শুরু হলো শফি ভাইয়ের প্রাণান্ত চেষ্টা। ঘুম নেই তার চোখে। সেই একটা পুরাতন দু’ চাকার সাইকেল নিয়ে ছুটছেন তো ছুটছেন। খুব ভোরে তিনি ঘর থেকে বের হন। ঘুম থেকে ডেকে তোলেন অনেককে। কেউ কেউ বিরক্ত হন ভোরে ঘুম ভাঙানের জন্য। কুছ পরোয়া নেই শফি ভাইয়ের। অবশেষে শুভক্ষণটি এসে গেল। এম. ইব্রাহিমকে সভাপতি এবং ইকবাল আতাহার তাজকে সম্পাদক করে সাহিত্য পরিষদের কমিটি গঠিত হলো। বিলুপ্ত হয়ে গেল উষা সহ অন্যান্য সাহিত্য সংগঠনগুলোর। যে লোকটির প্রচেষ্টা ছিল সর্বাধিক তিনি হলেন একজন সদস্য মাত্র। তাতে কি?
১৯৭৭ সালের ২০ নভেম্বর সাহিত্য পরিষদের আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানের দিন স্থির হলো। প্রধান অতিথি কে হবেন। শফি ভাই ড. আনোয়ারুল করিমের কাছে ছুটে গেলেন কুষ্টিয়া। তিনি রাজী হলেন। শ্রীমন্ত টাউন হলে চুয়াডাঙ্গা সাহিত্য পরিষদের আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠান হলো। নানান আয়োজনের মধ্যে শফি ভাইয়ের রচিত অনেকগুলি গান সেদিন চুয়াডাঙ্গার বিভিন্ন শিল্পী পরিবেশন করেন। কিভাবে সাহিত্য পরিষদকে উন্নতির চরম শিখরে নিয়ে যাওয়া যায়, কিভাবে প্রগতিমনা মানুষদের সাহিত্যমুখী করা যায় তার জন্য শফি ভাই অক্লান্ত পরিশ্রম শুরু করলেন। হাসপাতাল রোডের ছোট্ট টালির ঘরটি চুয়াডাঙ্গার সাহিত্য সেবীদের পদচারণায় রাত দিন মুখরিত হয়ে উঠল। প্রতি রবিবার সাহিত্য আসর শুরু হলো। শফি ভাইয়ের চিন্তার শেষ নেই। সাহিত্য পরিষদের জন্য একটি অফিস চাইই চাই। কোথায় পাওয়া যায় অফিস? ইউনিয়ন পরিষদের এ্যাসোসিয়েশনের পিছনে পরিত্যক্ত ‘কুঞ্জ আফিয়েত’ আমরা সকলে মিলে দেখতে গেলাম। শফি ভাই ছুটলেন তৎকালীন পৌর চেয়ারম্যান দাউদ হোসেনের কাছে। সম্মতি আদায় করে পরের দিনই পরিস্কার পরিচ্ছন্নের কাজে নেমে পড়লাম সকলে, চুয়াডাঙ্গা সাহিত্য পরিষদের অফিস হয়ে গেল। ১৯৭৯ সালের অক্টোবরে প্রকাশিত হলো শফি ভাই এর গীতিকাব্য ‘মাটি ও মানুষ’। চুয়াডাঙ্গা প্রেসক্লাবের সম্পাদক তখন কামরুল আরেফিন ভাই। প্রেসক্লাবে জাঁকজমকভাবে বইটির প্রকাশনা উৎসব করলেন। নির্মল সেন প্রধান অতিথি। নির্মল সেন ঢাকায় ফিরে গিয়ে ‘মাটি ও মানুষ’ সম্পর্কে দৈনিক সংবাদে দীর্ঘ নিবন্ধ লিখলেন। ঐ নিবন্ধে মাটি ও মানুষের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য কি তিনি বিস্তারিতভাবে তুলে ধরলেন। বইটির একটি কপি আমার হাতে তুলে দিলেন। নিজ হাতে লিখলেন ‘øেহভাজন মুহঃ আলাউদ্দীনকে- শফিউদ্দিন ১৭-১-৮০’। তার এই অটোগ্রাফ পরম যতেœ আজো সংরক্ষণ করে রেখেছি। শুধু এই অটোগ্রাফই নয়- ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘আমার হাতের মুঠোয় সভ্যতার শুভ্র শতদল’ এ লিখলেন ‘সংস্কৃতি আন্দোলনের নির্ভীক সৈনিক বন্ধুবর জনাব আলাউদ্দিনকে- শফিউদ্দিন ২১/১/৯৯’। এ অটোগ্রাফটি সযতেœ লালন করে চলেছি। এই অটোগ্রাফটি আমাকে আরো সাহসী করে তুলেছে। তাইতো সরকারী চাকুরীজীবী হয়েও সংস্কৃতি আন্দোলনের সহ যোদ্ধাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে প্রগতি বিরুদ্ধবাদীদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে পেরেছি, আজো তা অব্যাহত আছে। মাটি ও মানুষের এবং আমার হাতের মুঠোয় সভ্যতার শুভ্র শতদলের কয়েকটি লাইন তুলে ধরছি।
মাটি ও মানুষ :
শোনরে মাটির সোনার মানুষ,/গাহি যার জয়গান/নহে নহে তারা স্বর্গ দেবতা/এ মাটিরই তাজা প্রাণ।
গন্তব্যে যেতেই হবে :
দিগন্তে গাঢ় লালিমা/ হয়তো বা সুপ্রভাত অত্যাসন্ন/ ঊষার নকিব হয়তো বা ক্লান্ত জনপদকে এখনি জানিয়ে দেবে/ পান্থ এগিয়ে চল সামনে এখনো অনেক পথ/গন্তব্যে যেতেই হবে।
১৯৭৭ হতে ১৯৮৬, কাজ আর কাজ। বিরাম নেই শফি ভাইয়ের এক মুহূর্ত। টাকার অভাব? কারও কাছে যেতে হবে? শফি ভাই তার জন্য সদা প্রস্তুত। আমাদের অনেক সময় লজ্জা করত কারও কাছে টাকার কথা বলতে। শফি ভাই বলতেন, তোমরা আমার পিছনে থাকবে। কোন অনুষ্ঠান হবে? টাকা নেই? তাতে কি শফি ভাই আছে না? পত্রিকা বের হবে? বিজ্ঞাপন চাই? শফি ভাই থাকতে ভাবনা কি? কয়েক বছরের মধ্যেই চুয়াডাঙ্গা সাহিত্য পরিষদ মর্যাদার শিখরে উঠে গেল। জাতীয়ভাবে পরিচিত হয়ে উঠল। কবি শামসুর রাহমান হতে শুরু করে দেশের অসংখ্য কবি সাহিত্যিকের পদার্পন ঘটল চুয়াডাঙ্গায়। পরবর্তীতে পশ্চিম বাংলার অন্যতম প্রধান কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের পদধূলিতে ধন্য হলো সাহিত্য পরিষদ। চুয়াডাঙ্গা হয়ে উঠল কবি সাহিত্যিক-সংস্কৃতি সেবীদের পাদপীঠ। কুঞ্জ আফিয়েত হয়ে উঠল তাদের প্রধান আড্ডাস্থল।
কিন্তু মহাকালও এক সময় গতি হারায় প্রাকৃতিক দুর্যোগে অথবা মনুষ্য সৃষ্ট আঘাতে। তেমনি শফি ভাইয়েরও ছন্দপতন ঘটল। ইতিমধ্যেই তিনি একাধিকবার সাহিত্য পরিষদের সম্পাদক ও সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর উত্থান, কর্মদক্ষতা, সততায় ঈর্ষান্বিত হয়ে একটি চক্র শুরু করল ষড়যন্ত্র। সাহিত্য পরিষদ থেকে একরকম অপমানিত হয়ে চলে আসতে হলো তাঁকে। ১৯৮৬ সাল। শফি ভাই বলতে গেলে প্রায় একা হয়ে গেলেন। ১৯৮৬ সালের অক্টোবরের প্রথম দিকে হবে। ইমারজেন্সি রোডে শফি ভাই বাজারের দিকে আসছেন। আমিও বাজারের দিকে যাচ্ছি। উভয়েই বাইসাইকেলে। মোজাম্মেল ডাক্তারের বাড়ীর কাছে শফি ভাই সাইকেল চড়া অবস্থাতেই চিৎকার করে বললেন, আলাউদ্দিন ভাই, বাসায় দেখা করেন জরুরী দরকার। শফি ভাইয়ের ডাক উপেক্ষা করার নয়। সেদিনই সন্ধ্যায় টালির ঘরে দু’ জনের একান্ত আলাপচারিতা। সাহিত্য পরিষদ সম্পর্কে বিশদ আলোচনা হলো। এক সময় শফি ভাই আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়লেন। আমি চৌকিতে উঠে গিয়ে গায়ে হাত দিয়ে সান্ত্বনা দিলাম। তিনি বললেন, কিছু একটা করা যায় না? শেষে দু’ জন পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিলাম শুধু সাহিত্য বা সংস্কৃতির সকল শাখাতেই যাতে কাজ করা যায় এমন একটি সংগঠন সৃষ্টি করা দরকার। সিদ্ধান্ত হলো সমমনাদের নিয়ে আগামী ২৫ অক্টোবর বসা হবে। দর্শনা অনির্বান সাংস্কৃতিক সংগঠনের (বর্তমান অনির্বান থিয়েটার) সাধারণ সম্পাদক মহসিন ভাইকে বিশেষভাবে আমন্ত্রণ জানানো হলো। আমার উপর দায়িত্ব পড়ল পলাশ পাড়ায় সবুজ নাট্যগোষ্ঠীর উল্লেখযোগ্য সদস্যদের নিয়ে আসা। যথাসময়ে আমি হারুন-অর-রশিদ, ইউনুস আলী, আনোয়ার হোসেন ও নজির আহমেদ উপস্থিত হলাম। শফি ভাই ইতিমধ্যে আ. শু. বাঙালী, আব্দুল মোমিন টিপু, মোক্তার আলী, আব্দুল মাবুদ জোয়ার্দ্দার, আসাদুল হক (আরো হয়তো অনেকে ছিলেন, স্মৃতি থেকে হারিয়ে গেছে অনেকের নাম। এর জন্য দুঃখিত) প্রমুখদের একত্রিত করলেন। দীর্ঘ আলোচনার পর নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত হলো দর্শনা অনির্বানের আদলে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন করা হোক। কি নাম হবে সংগঠনের? আমি ডিকশনারীর পাতা উল্টাত লাগলাম, হারুন আমার পাশে বসা। দীর্ঘক্ষণের আলোচনায় যে বিষয়টি স্থান পেল তা হলো সংস্কৃতির নামে যারা সংস্কৃতির বিরুদ্ধেই সখ্যতা করে আমরা তাদের বিপক্ষে। ‘অরিন্দম’ শব্দটি পেয়ে গেলাম। হারুনকে দেখালাম। হারুন নীরব সম্মতি দিলে সকলকে নামটি বলার সাথে সাথে একবাক্যে সকলে সমর্থন করল। ‘অরিন্দম সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী’ নামকরণ (পরবর্তীতে সংগঠন) করে সংগঠনের নাম হলো। সিদ্ধান্ত হলো আপাততঃ একটি আহ্বায়ক কমিটি হবে। এক বৎসরের মধ্যে সম্মেলনের মাধ্যম পূর্ণাঙ্গ কমিটি হবে। কে হবে আহ্বায়ক? আমাদের সকলেরই বিশেষ করে আমার ধারণা ছিল শফি ভাই হবেন আহ্বায়ক। কিন্তু সকলকে বিশেষ করে আমাকে চমকে দিয়ে শফি ভাই আমার নাম প্রস্তাব করলেন। আমি তো রীতিমত অবাক। কারণ বাঙালী ভাই, শফি ভাই আমার বয়োজ্যেষ্ঠ। আমি জোর করে আপত্তি জানালাম। আমার আপত্তি টিকল না। কেননা শফিউদ্দিন প্রস্তাব করেছেন যে। অতএব আমাকে আহ্বায়ক এবং সর্বজনাব শফিউদ্দিন, আ. শু. বাঙালী, হারুন-অর-রশিদ, নজির আহমেদ, ইউনুস আলী, আনোয়ার হোসেন, আব্দুল মাবুদ জোয়ার্দ্দার, আব্দুল মোমিন টিপু, রাজীব হাসান কচি ও আশরাফ আমীনকে নিয়ে ১৩ সদস্য বিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটি গঠিত হলো। এই কমিটি ২৫/১০/৮৮ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করল। গাংনীর অধ্যাপক রফিকুর রশিদ তখন চুয়াডাঙ্গা পৌর কলেজ হতে সবেমাত্র গাংনী কলেজে যোগদান করেছেন। বিশিষ্ট সংস্কৃতিকর্মী কৃষিবিদ হামিদুর রহমান তখন কুষ্টিয়ায় চাকুরীরত। তাঁদের জানানো হলো। এক সপ্তাহের মধ্যে আহ্বায়ক কমিটির সভা আহ্বান করে সংগঠনের খসড়া গঠনতন্ত্র রচনার জন্য হামিদুর রহমানকে দায়িত্ব দেওয়া হলো। আরো সিদ্ধান্ত হলো প্রথমে একটি নাটক প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে সংগঠনের আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠান হবে। নাটক নির্বাচনের জন্য আমাকে, হারুন-অর-রশিদ, ইউনুস আলী, নজির আহমেদ, আদিল হোসেন, রাজীব হাসান প্রমুখদের দায়িত্ব দেওয়া হলো। আমরা অনেক চেষ্টা করেও মঞ্চায়নপোযোগী কোন পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ করতে পারলাম না। এগিয়ে এলেন শফিউদ্দিন। আমাকে বললেন, আপনিই নাটক লিখে ফেলেন। আমি বললাম, গল্প লেখা ও নাটক লেখা এক নয়। তিনি নাছোড়বান্দা। না আমাকেই লিখতে হবে। শুরু করলাম পড়াশোনা। বংশী মুখোপাধ্যায়ের ‘কুম্ভকর্ণের ঘুম’ অবলম্বনে দর্শনা অনির্বান ইতিমধ্যেই একটি নাটক মঞ্চস্থ করেছে। ঐ গল্পকে অবলম্বন করে লিখে ফেললাম ‘বাতাসীর জন্যে যুদ্ধ’। মহড়া দিতে হবে। কোথায় মহড়া হবে? জায়গা কোথায়? আবারও হাজির শফিউদ্দিন। ফকির মিয়ার ধানকলের ভিতর একটি পরিত্যক্ত ঘর ছিল। শফি ভাইয়ের প্রচেষ্টায় সেখানেই শুরু হলো মহড়া। আবারও আহ্বায়ক কমিটির সভা। সিদ্ধান্ত হলো ২৮ নভেম্বর ‘বাতাসীর জন্যে যুদ্ধ’ নাটক মঞ্চায়নের মধ্য দিয়ে অরিন্দমের আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠান হবে। ডঃ আনোয়ারুল করিমকে প্রধান অতিথি হিসাবে আমন্ত্রণ জানানার জন্য শফি ভাই চলে গেলেন কুষ্টিয়া। শ্রীমন্ত টাউন হলে ২৮ নভেম্বর নাটক প্রদর্শিত হলো। উপস্থিত দর্শক নাটকের ভূয়সী প্রশংসা করল। করিম সাহেব মঞ্চে উঠে এসে সকল অভিনেতা অভিনেত্রীকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। তিনি নাতিদীর্ঘ একটা বক্তব্য দিয়ে ফেললেন। তখন নাটকে অভিনয় করার জন্য স্থানীয় মেয়ে পাওয়া দুরূহ ছিল। ঝিনাইদহ থেকে শিউলী নামের একটি মেয়েকে নিয়ে আসা হলো। তারপর থেকে শিউলী নিয়মিত অরিন্দমে নাটক করতে লাগল। শুরু হলো নাটক দিয়ে অরিন্দমের পথচলা। অর্থ সংগ্রহ থেকে শুরু করে যাবতীয় কার্যক্রমে শফিউদ্দিন অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে লাগলেন। নামে মাত্রই আহ্বায়ক আমি। বিরাম নেই শফি ভাইয়ের। প্রসঙ্গক্রমে একটি কথা না বললেই নয়। শফি ভাইয়ের আর একটি জীবন ছিল। সেটা হলো তাঁর রাজনৈতিক জীবন। তিনি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় সদস্য ছিলেন। আমি পার্টির আদর্শে যত না উদ্বুদ্ধ হয়ে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিলাম, তার চেয়েও বেশি উদ্বুদ্ধ হলাম শফি ভাইয়ের আদর্শে। যেহেতু শফি ভাই ইউনিয়ন পরিষদের সেক্রেটারী পদে চাকরী করতেন সেহেতু প্রকাশ্যে রাজনীতি করতে পারতেন না। ফলে আমরা যারা সরকারী চাকরী করতাম তাদের নিয়ে গঠন করা হলো পার্টির বিশেষ শাখা (ঝই)। বিশেষ শাখার সভাপতি শফি ভাই, আমি, মোক্তার আলী, লুৎফর রহমান, রফিকুর রশিদ, রঞ্জিত কুমার (আরো অনেকে ছিলেন, এই মুহূর্তে তাঁদের নাম স্মরণ করতে পারছি না) সদস্য। পার্টি এবং সংগঠনের কার্যক্রম একসঙ্গে চলতে লাগল। আজ স্বীকার করতে দ্বিধা নেই- পার্টি নেতা-কর্মীদের পরোক্ষ পরামর্শেই অরিন্দম গঠন করা হয়েছিল। যেটা পরে আমি জানতে পারি। মূলতঃ অরিন্দমের যাবতীয় কর্মকাণ্ড পার্টির মেনিফেস্ট অনুযায়ীই চলতে লাগল।
এর মধ্যেই হামিদুর রহমান চমৎকার এক গঠনতন্ত্র প্রস্তুত করে ফেললেন। দু’ বছর পরপর যখনই সম্মেলন আসে তখনই আমি সম্পাদক না হলে যেন সংগঠন বন্ধ হয়ে যাবে সেই আশংকায় আমাকে সম্পাদক হওয়ার অনুরোধ করতেন শফি ভাই। এমনিভাবে তারই অনুরোধে দীর্ঘ ষোল বছর সম্পাদকের দায়িত্ব পারন করতে হলো। এই একটি বিষয়ে আজ আমি দ্বিধাহীনভাবে বলতে চাই, শফি ভাই এর সে সময়ের ধারণাটি সর্বাগ্রে সঠিক ছিল না। কারণ ব্যক্তি সংগঠনের জন্য কখনও অবধারিত হতে পারেন না, সংগঠনই সব। একজন ব্যক্তির অনুপস্থিতিতে সংগঠন হয়তো সাময়িকভাবে থমকে যায়- কিন্তু সংগঠনের নীতি আদর্শ যদি সঠিক থাকে তাহলে আবারও ঘুরে দাঁড়াবে। আদর্শের কথা যখন এসে গেল তখন একটা কথা না বলে পারছি না। হামিদুর রহমান সংগঠনের যে গঠনতন্ত্র প্রণয়ন করেন তাতে ‘বাঙালী সংস্কৃতির প্রগতিশীল বিকাশ চাই’ হলো সংগঠনের মূলমন্ত্র। আজ বলতে বাধ্য হচ্ছি সংগঠনের ঐ মূলমন্ত্রে বিশ্বাসী কয় জন? আজ মাবুদ মালিকের একটা কথা মনে পড়ছে। মাবুদ মালিক প্রায়ই বলত, বাঙালী সংস্কৃতির প্রতি বিশ্বাসী-অবিশ্বাসী আগে চিহ্নিত হওয়া দরকার। একটা উদাহরণ দিই। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর আদর্শ নিয়ে প্রায়ই পত্রিকায় লেখালেখি হয়। অনেকে মত প্রকাশ করেন দল এখন নব্য আদর্শবাদীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং পরিচালিত হচ্ছে।
লিখছিলাম শফি ভাই সম্পর্কে। ১৯৮৮ সালে প্রথম সম্মেলনে তিনি কিছুতেই সভাপতি হতে রাজী হলেন না। ফলে মোক্তার আলীকে সভাপতি করা হলো। পরের সম্মেলনে তিনি আর রক্ষা পেলেন না। শত আপত্তি সত্বেও বাধ্য হলেন সভাপতি হতে। এই নির্লোভ, নিরহংকারী মানুষটির একাগ্রতায় অরিন্দম সামনের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। ১৯৯৩, ১৯৯৪, ১৯৯৫, ১৯৯৬, ১৯৯৭ বলতে গেলে অরিন্দমের স্বর্ণযুগ। সংস্কৃতি হোক মুক্ত জীবনের আবাহান, সংস্কৃতি ওড়াবেই মানব পতাকা, সংস্কৃতি রুখবেই সাম্প্রদায়িকতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারায় সংস্কৃতির বিকাশ চাই, রাজনৈতিক সংস্কৃতির উত্তরণ চাই, মুক্ত কর ভয়, আপনা মাঝে শক্তি ধর নিজেকে কর জয়, আঁধার কেটে যাক আলোর উৎসবে ইত্যাদি শ্লোগানে ৫ দিন/৭ দিন ব্যাপী ‘অরিন্দম সাংস্কৃতিক উৎসব’ পালিত হয়েছে। বয়সের ভারে যদিও শফি ভাই তখন অনেকটাই কর্মশক্তি হারিয়ে ফেলেছেন তথাপি তাঁরই প্রেরণায় কৃষিবিদ হামিদুর রহমানের সাথে আমরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে উৎসবগুলি সফল করে তুলেছিলাম। বয়স্কদের প্রেরণা, আদেশ আমাদের কাছে বেদবাক্য মনে হতো। আজকে বড় কষ্ট হয় যখন দেখি সর্বকনিষ্ঠ সদস্যটি আড়ালে আবডালে কখনও সামনে প্রকাশ্যেই সর্বজ্যেষ্ঠ সদস্যকেও কটাক্ষ করতে পিছপা হয় না ও মতামতের মূল্য দেয় না। তাহলে শফি ভাই এর আদর্শ, শিক্ষা, আমাদের প্রচেষ্টা সবই কি বৃথা? আমরা কি সত্যি সত্যিই ব্যর্থ। মাঝে মাঝে ভাবি, এই ব্যর্থতার গ্লানি থেকে মুক্তি পাব কবে? কিন্তু একটা কথা আছে, হামি তো কমলাকে ছোড়তি হ্যায়, লেকিন কমলা তো হামাকে ছোড়তি নেহী। পারিবারিক জীবনে মানুষটি খুব সুখী ছিলেন না। তাঁর অনেক আকাঙ্খার কথা, আশার কথা আমাকে একান্তে বলতেন। ছেলেকে বিদেশে পাঠালেন ডাক্তারী পড়াতে। দেশে এসে দেশের মানুষের সেবায় আত্মনিয়োগ করবে। কিন্তু ছেলে বিদেশেই স্থায়ী হয়ে গেল। এটা তার বড় একটা কষ্ট ছিল। আরো বিভিন্ন কারণে পারিবারিক দ্বন্দ্বে তিনি চুয়াডাঙ্গা ছেড়ে দ্বিতীয় স্ত্রীর কাছে জাফরপুরে বসবাস করতে লাগলেন। প্রথম স্ত্রী বর্তমান থাকতে দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণের জন্য স্বভাবতই তাকে ভাল না লাগার কথা। তিনি হয়তো আমার মনোভাবটি আঁচ করতে পেরেছিলেন। একদিন একান্তে এর কারণ ব্যাখ্যা করলেন। কারণটি একেবারেই তাঁর ব্যক্তিগত ও পারিবারিক। সে কারণটা অনুচ্চারিতই থেকে যাক।
আমরা আর তাঁকে কাছে পেলাম না। কিন্তু তার পরামর্শের জন্য প্রায়ই ছুটে যেতাম জাফরপুর। ক্রমান্বয়ে শফি ভাই এর স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়ল। দৃষ্টিশক্তি লোপ পেল। ধীরে ধীরে তিনি একেবারেই অন্ধ হয়ে গেলেন। আর্থিক সংকটে জর্জরিত হয়ে পড়লেন। চিকিৎসা করার সামর্থ্যও থাকল না। মানসিকভাবে চরমভাবে ভেঙ্গে পড়লেন। পরিবার, সমাজ, তার হাতে গড়া সংগঠন অরিন্দমের কর্মীদের থেকে একরকম বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেন। তার আদর্শের রাজনৈতিক দলটিও এক রকম নিষ্ক্রিয়ই বলা যায়। নানান দিকের ভাবনায় তিনি একেবারেই নিস্তেজ হয়ে গেলেন। অবশেষে সাংস্কৃতিক অঙ্গনের এই মহীরূহ ২৪ নভেম্বর তারিখে চিরবিদায় নিলেন। তার অন্তিম ইচ্ছা অনুযায়ী অরিন্দম চত্ত্বরে লাশ নিয়ে এসে শেষ শ্রদ্ধা জানালাম আমরা।
চলে গেছেন শফি ভাই, রেখে গেছেন তার বিশাল কর্মভাণ্ডার। আজ যখন বিশ্বজুড়ে ধর্মের নামে চলছে হত্যাযজ্ঞ, তখন শফি ভাইয়ের মত মানুষদের বড় প্রয়োজন। কেননা শফি ভাই ছিলেন প্রগতিবাদী অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী মানুষ। আসুন আমরা শফি ভাইয়ের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে এই অপশক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াই, নিঃশেষ করে দিই তাদের।