সভাপতির কথা
![](https://www.arindamchuadanga.org/wp-content/uploads/2021/04/nurul-388x418-1-388x418.jpg)
বাংলায় বিপ্লবী নাটকের চরম বিকাশকাল বলা যায় বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের পূর্ব মুহূর্ত, যুদ্ধকালীন সময় এবং তদপরবর্তীকালে ১৯৭১ সালের ১৫ মার্চ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী ঢাকার বিভিন্ন স্থানে খোলা ট্রাকে মঞ্চস্থ করে ‘শপথ নিলাম’। বেতার-টেলিভিশন শিল্পী সমাজ ১৬ মার্চ শহীদ মিনারে মঞ্চস্থ করে ‘ভোরের স্বপ্ন’। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বিপ্লবী নাট্য আন্দোলনের ধারা অব্যাহত থাকে। এ সময় মুক্তিযুদ্ধকে প্রত্যক্ষ করে কল্যাণ মিত্রের ‘জল্লাদের দরবার’ একটি জাতি একটি ইতিহাস, মামুনুর রশীদের মুক্তির ডাইরী ‘মৃত্যুহীন প্রাণ’ নাটক স্বাধীন বাংলা বেতর কেন্দ্র থেকে সম্প্রচার হত। এছাড়াও মুক্তিযুদ্ধকালীন স্মরণযোগ্য নাটক মমতাজ উদ্দিন আহমদের ‘স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতা’, ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’, ‘বর্ণচোরা’, মামুনুর রশীদের ‘বর্ণচোরা’, নিলীমা ইব্রাহিমের ‘যে অরণ্যে আলো নেই’, রনেশ দাস গুপ্তের ‘ফেরি আসছে’। মহান মুক্তিযুদ্ধের পরেও মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বহু বিপ্লবী ধারার নাটক রচিত হয়েছে। তন্মধ্যে সৈয়দ শামসুল হকের পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় সবচেয়ে আলোড়িত নাটক। ৭৫’ এর পট পরিবর্তনের পর সামরিক জান্তার স্বৈরাচারেরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভূলুণ্ঠিত করে ধর্মভিত্তিক পাকিস্তানী রাষ্ট্র চেতনার পথে ধাবিত হলে বিপ্লবী ধারার নাট্য রচনা বাড়ে বৈ কমে না। মমতাজ উদ্দিনের ‘কী চাহ শঙ্খচীল’ এ সময়ের অন্যতম মঞ্চল সফল নাটক। এ সময়ে মামুনুর রশীদের ‘এখানে নোঙর’, আব্দুল্লাহ আল মামুনের ‘মেহেরজান আরেকবার’ শ্রেণি চেতনতার দু’টি জনপ্রিয় নাটক। গাঙের অববাহিকায় জেগে ওঠা নতুন চরকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে ‘এখানে নোঙর’ নাটকের অবয়ব। চরে নতুন করে বসবাস করতে আসা বিত্তহীন সহায় সম্বলহীন কৃষক সমাজের সংগ্রামী জীবন নিয়ে গড়ে উঠেছে এ নাটকের আখ্যানভাগ। মামুনুর রশীদের অন্যান্য নাটকের মত এ নাটকেও অত্যাচারিত ও শোষিত বঞ্চিত মানুষেরা ক্রমেই হয়ে উঠেছে অধিকার সচেতন, শ্রেণি সচেতন। শেষমেষ অত্যাচারী শোষকের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে শোষিত মানুষ। আব্দুল্লাহ আল মামুনের ‘মেহেরজান আরেকবার’। মেহেরজান বিবি একই সঙ্গে বঞ্চিত ও প্রতিবাদী নারীর প্রতীক। সেই সাথে বাঙ্গালীর চিরায়িত অসাম্প্রদায়িক চেতনারও প্রতীক বটে। এছাড়া এ নাট্যকারের ‘এখনও ক্রীতদাস’ আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় লালিত একটি বিপ্লবী চেতনার নাটক। আধুনিক যুগে মান্নান হীরার ‘লাল জমিন’ মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক একটি ভিন্ন স্বাদের বিপ্লবী নাটক। মামুনুর রশীদের ‘রাঢ়াং’ আধুনিক বাংলা নাট্যকাব্যে শ্রেণি চেতনার এক শানিত ট্রাজেডি। এ নাটকে দেখানো হয়েছে সুবিধাবাদী জোতদার শাসকেরা হিন্দু-মুসলমান-খিস্টান যে ধর্মের লোকই হোক না কেন সবার চরিত্র একই। হিন্দু-মুসলমান-খ্রিস্টান সব ধর্মের ধনিক শ্রেণির লোকেরা গরীব অসহায় আদিবাসীদের সহায় সম্পত্তি দখলের উদ্দেশ্যে কিভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়ে তাদেরকে ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদের চেষ্টা করে। অরিন্দম সাংস্কৃতিক সংগঠন প্রযোজিত মোঃ আলাউদ্দিন রচিত ‘নীল সিন্দুরিয়া’ নাটকটি বাঙ্গালীদের বিপ্লবী চেতনার আরেকটি দলিল। এ যেন লোকচক্ষুর আড়ালে অন্ধকার কূপের মধ্যে পড়ে থাকা এক টুকরো হীরক খণ্ড। চুয়াডাঙ্গা-ঝিনাইদহ ও তদপার্শ্ববর্তী অঞ্চলের নীলচাষের বিরুদ্ধে কৃষকদের বিদ্রোহ বন্দনা অন্ধকার থেকে আলোয় তুলে আনেন ইউসুফ হোসেন। তাঁর প্রবন্ধের ঘটনার ঘনঘটাগুলো নাট্যরূপ দিয়ে সভ্য মানুষের দরবারে হাজির করেন মোঃ আলাউদ্দিন।
মানুষের মুক্তির সংগ্রাম কখনও শেষ হয় না। সমাজে পুঁজি আছে, লুটেরা পুঁজিপতিও আছে। লুটেরা পুঁজিবাদ শোষণ করতে আর বঞ্চিত শোষিত মানুষেরা। শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে চাই। শোষক আর শোষিতের এই চিরপ্রবাহমান দ্বন্দ্ব বিবেকবান আদর্শবান সাহিত্যিক তথা নাট্যকারদের নিরন্তর প্রেরণা যোগায়, সাহসী করে তোলে। তাই সমাজ ও ইতিহাসের বাস্তবতার নিরিখে প্রত্যহ তৈরী হয় নাটকের বিপ্লবী সত্ত্বা। মৌলবাদ-জঙ্গিবাদ ও তাদের লালনকর্তা সাম্রাজ্যবাদের বিষ নখর ভাঙতে আগামীতেও রচিত হবে চৈতন্য প্রখর প্রতিবাদী নাটক- এই প্রত্যাশা আমাদের নাট্যমোদিদের।
মানুষের মুক্তির সংগ্রাম কখনও শেষ হয় না। সমাজে পুঁজি আছে, লুটেরা পুঁজিপতিও আছে। লুটেরা পুঁজিবাদ শোষণ করতে আর বঞ্চিত শোষিত মানুষেরা। শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে চাই। শোষক আর শোষিতের এই চিরপ্রবাহমান দ্বন্দ্ব বিবেকবান আদর্শবান সাহিত্যিক তথা নাট্যকারদের নিরন্তর প্রেরণা যোগায়, সাহসী করে তোলে। তাই সমাজ ও ইতিহাসের বাস্তবতার নিরিখে প্রত্যহ তৈরী হয় নাটকের বিপ্লবী সত্ত্বা। মৌলবাদ-জঙ্গিবাদ ও তাদের লালনকর্তা সাম্রাজ্যবাদের বিষ নখর ভাঙতে আগামীতেও রচিত হবে চৈতন্য প্রখর প্রতিবাদী নাটক- এই প্রত্যাশা আমাদের নাট্যমোদিদের।